জাগ্রত সিলেট ডেস্ক :: সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের একের পর এক অপকর্ম বেরিয়ে আসছে। দেশের অন্তত ১১ জেলায় সম্পদের খোঁজ পাওয়ার পর এবার বিদেশে বেনজীরের বিলাসবহুল বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সন্ধানে নেমেছে দুদক। দুদকের প্রাথমিক সন্ধানে অন্তত সাতটি দেশে বেনজীরের সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, স্পেনে ও তুরস্কে তার ব্যবসা ও সম্পদ রয়েছে। আর মালয়েশিয়ায় আবাসন খাতেও বিনিয়োগ রয়েছে তার।
এদিকে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেছেন, ৬ জুন (আজ) বেনজীর আহমেদ না এলে দুদক ধরে নেবে তার কোনো বক্তব্য নেই। তবে বেনজীর চাইলে সময় দেবেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। সম্প্রতি বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অভিযোগ আসার পর দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধান টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে।
শুরুতে ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে অন্তত ৬২১ বিঘা জমির সন্ধান পায় দুদক। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, কিশোরগঞ্জ ও গাজীপুরে বেনজীর ও তার পরিবারের বিশাল সম্পত্তির খোঁজ পায় তারা। এসব জেলায় রয়েছে জমি, খামার, রিসোর্ট। সেন্টমার্টিন দ্বীপে রয়েছে তার বিশাল জমিদারি। দুদকের অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার শুরুর আগেই বেনজীর গোপন ব্যাংক থেকে ৭০-৮০ কোটি টাকা তুলে গোপনে তিনি সপরিবারে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, বেনজীর ব্যাংক, পুঁজিবাজারে ছড়িয়ে রেখেছিলেন অর্থ। নিজের অঢেল অর্থ সম্পদের তথ্য আড়াল করার জন্য কখনো সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহার করেননি। সাধারণ পাসপোর্ট নিয়ে বিভিন্ন দেশে ঘুরেছেন। যেখানে ঘুরেছেন, সেখানে আলিশান ফ্ল্যাট ও সম্পদ কিনেছেন। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন।
অন্তত সাত দেশে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের কোনো সম্পদ আছে কি না- তার অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। বিদেশে তার সম্পদ খুঁজতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) চিঠি দিয়েছে দুদক। দুদকের কাছে তথ্য রয়েছে, অন্তত সাতটি দেশে বেনজীরের সম্পদ থাকতে পারে। মালয়েশিয়ায় আবাসন খাতে তার বিনিয়োগ রয়েছে বলেও তথ্য পেয়েছে দুদক।
বেনজীর চাইলে সময় দেবেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা : দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেছেন, অবৈধ সম্পদ ও দুর্নীতির বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদকে ৬ জুন ডেকেছে দুদক। এদিন হাজির না হলে তার কোনো বক্তব্য নেই বলে ধরে নেওয়া হবে। মঙ্গলবার বিকেলে দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।
দুদক কমিশনার বলেন, ৬ জুন বেনজীর না এলে দুদক ধরে নেবে তার কোনো বক্তব্য নেই। তবে বেনজীর চাইলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা তাকে আরও ১৫ দিন সময় দিতে পারবে।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেনজীর আহমেদকে আগামী ৬ জুন তলব করেছে দুদক। একই অভিযোগে ৯ জুন তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুদক।
জেলায় জেলায় বেনজীরের রাজত্ব : ঢাকাসহ অন্তত ১১ জেলায় সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, কিশোরগঞ্জ সদরের ধরেয়ার বাজার এলাকায় যৌথ মালিকানায় বেনজীরের একটি খামার রয়েছে। এখানে খামারের জন্য নামে-বেনামে শত শত বিঘা জমি কেনা হয়েছে। এই খামারের আরেক অংশীদার স্বাস্থ্য খাতের বিতর্কিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। আর এটি দেখভাল করে মিঠুর ভাই মানিক হাজি। বেনজীর র্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালে তাকে হেলিকপ্টারে সেখানে নিয়ে যান মিঠু। র্যাবের পোশাক দেখে ভয়ে কৃষকরা তাদের জমি কমদামে মিঠুকে হস্তান্তর করেন।
এদিকে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নে ‘ভিন্ন জগৎ পার্ক’ সংলগ্ন এলাকায় অন্তত ৫০ বিঘা জমির ওপর নর্থ পোল্ট্রি খামার এবং মুরগির খাবার উৎপাদন কারখানা রয়েছে। সেটি উদ্বোধনের সময়ও বেনজীর আহমেদ ও ঠিকাদার মিঠু উপস্থিত ছিল। সেখানে তাদের যৌথ মালিকানা রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও সদরের জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বড় খোজাবাড়ি এলাকায় কয়েক বিঘার জমির ওপর আরেকটি খামারে বেনজীরের অংশীদারত্ব রয়েছে বলে জানা গেছে। এতেও স্বাস্থ্য খাতের বিতর্কিত ঠিকাদার মিঠু অংশীদার।
সূত্রগুলো জানায়, দুলাভাই আইজিপি বেনজীরের দাপট দেখিয়ে মির্জা আনোয়ার পারভেজ সাতক্ষীরা সদরের দক্ষিণ আলীপুর গ্রামে ৪৮ বিঘা জমির ওপর আশরাফুজ্জামান হাবলু নামের এক ব্যক্তির ইটভাঁটি দখল করে নেয়। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শোভনালী ইউনিয়নের শরাফপুর গ্রামের বেনজীরের শাশুড়ি লুৎফুন নেসার নামে শতাধিক বিঘার ওপর চারটি মাছের ঘের আছে। সেখানকার গ্রামবাসীদের ধারণা, এগুলোতে বেনজীরই বিনিয়োগ করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ১০ বছর আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ঘেঁষে বেনজীর আহমেদ নিজ নামে চার বিঘা জমি কেনেন। এ ছাড়া কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের ইনানী সৈকতে তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে কেনা হয়েছে ৭২ শতক জমি। এসব জমি কেনার সময় তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন।
অপরদিকে গোপালগঞ্জ সদরের বৈরাগীটোল গ্রামে এক হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক রয়েছে বেনজীরের। সেখানে আছে কৃত্রিম ঝরনা, বিলাসবহুল ডুপেক্স কটেজ, সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিংপুল, একাধিক পুকুর, বিশাল কনসার্ট হল ও কৃত্রিম পাহাড়। অভিযোগ রয়েছে, এই রিসোর্টের জন্য সংখ্যালঘুদের জমি দখল করা হয়েছে। সেখানে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে প্রায় ৩০০ বিঘা চাষের জমি রয়েছে। আর মাদারীপুরের রাজৈরের সাতপাড় গ্রামে তার স্ত্রী জিশান মির্জার নামে একাধিক দলিলে ২৭৩ বিঘা জমি রয়েছে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগে বেনজীর এসব জমি কেনেন। এছাড়া গাজীপুর সদরে আধুনিক ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টারে বেনজীরের ২৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ১৫০ বিঘা জমির ওপর এই রিসোর্ট আম্বার গ্রুপের। আর কালীগঞ্জের বেতুয়ারটেক গ্রামে বেনজীর, তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে ৪০ বিঘা জমির সন্ধান পেয়েছে দুদক।
অপরদিকে বেনজীরের দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচ তারকা হোটেল লো মেরিডিয়েনের দুই লাখ শেয়ার রয়েছে। ২০১৯ সালে এই শেয়ার কেনা হয়। ওই সময় তিনি র্যাবের ডিজি ছিলেন।
সূত্র জানায়, ২৩ মে বেনজীর আহমেদের সম্পত্তির ৮৩টি দলিল জব্দের আদেশ দেন আদালত। সঙ্গে দেওয়া হয় ৩৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ। ২৬ মে বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের ১১৯টি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ আসে আদালত থেকে। এ ছাড়া রাজধানীর গুলশানের আলিশান চারটি ফ্ল্যাট, শতভাগ এবং আংশিক মালিকানাধীন ২৩ কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশও দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ডিএমপি কমিশনার ও র্যাবের ডিজি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব এবং র্যাবের সাবেক ও বর্তমান যে সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নাম আছে। তখন তিনি আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন।
Leave a Reply